এহতেশাম রফিক
হামলা, বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাটের পর ঝিনাইদহের হরিশংকরপুরে এবার শুরু হয়েছে গাছ কেটে বিক্রি করা। গ্রামের কমপক্ষে ৪০ টি পরিবার দীর্ঘদিন বাড়ি ছাড়া থাকার সুযোগে প্রতিপক্ষরা মাঠ থেকে মুল্যবান সব গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছেন। গত এক মাসে কমপক্ষে ১০ কৃষকের শতাধিক গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ দলের সন্ত্রাসীরা। পুলিশ চুরি যাওয়া গাছ কয়েকদফা জব্দও করেছে, তারপরও গাছকাটা বন্ধ হচ্ছে না।
গাছের মালিকরা বলছেন, সরকার দলের গোলমালে ২ জন খুনের ঘটনাকে পুজি করে স্থানীয় একটি মহল প্রথমদিকে বেশ কিছু নিরিহ মানুষের বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাট করে। তাদের বাড়িছাড়া করা হয়। এখন আর্থিক ভাবে আরো ক্ষতি করতে আর নিজেরা লাভবান হতে গাছ কেটে নিচ্ছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে তারা সদর থানায় লিখিত অভিযোগও করেছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন বিকালে সাড়ে ৫ টার দিকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের হরিশংকরপুর গ্রামে একদল সন্ত্রাসীর হামলায় নিহত হন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের দুই নেতা আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। যে মামলার ১৪ জন আসামী বর্তমানে জামিনে আছেন, বাকি ১১ জন কারাগারে।
হরিশংকরপুরবাসি জানান, তাদের ইউনিয়নে দুইটি সামাজিক দল রয়েছে। একটির নেতৃত্ব দেন বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাসুম ও অপরটির সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ। এরা দু’জনই আওয়ামীলীগের নেতা। এই দুই নেতার লোকজনের মধ্যে মাঝে মধ্যেই সংঘর্ষ, বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। গত ১০ বছরে এই ইউনিয়নে উভয়পক্ষের ৫ জন জীবন দিয়েছেন। আর একটা হত্যাকান্ড ঘটার পর এলাকায় শুরু হয়ে যায় ভাংচুর ও লুটপাট। ঘটনায় জড়িত না থাকলেও সামাজিক দলভুক্ত লোকজনের বাড়িঘরও রক্ষা পায় না। স্থানীয়রা আরো জানান, ঘটনার পর চার গ্রামের প্রায় ৪ শত পুরুষ বাড়ি ছাড়া রয়েছে। গোটা ইউনিয়নে ক্রাসের রাজত্ব চলছে। হরিশংকরপুর, চন্দ্রজানি, শিতারামপুর ও পরানপুর গ্রামের তিন শতাধিক পরিবারের পুরুষ মানুষগুলো আজো বাড়ি ছাড়া রয়েছেন। যাদের মাঠের কৃষিকাজও বন্ধ রয়েছে।
হরিশংকরপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম বিশ^াস জানান, তার ৯ টি মেহগুনি ও ৩ টি কাঠাল গাছ কেটে নিয়েছে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা। তিনি খোজ পেয়েছেন গাছগুলো ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। তার আরো বেশ কিছু গাছ কেটে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। নিজে বাড়িতে যেতে পারেন না, তাই সবগুলোর সঠিক হিসাব দিতে পারছেন না। তিনি আরো জানান, তাদের গ্রামের দুদু মল্লিকের প্রায় দেড় লাখ টাকা মুল্যের ১৩ টি মেহগুনি, নেকবার আলীর ৪০ হাজার টাকা মুল্যের ৯ টি মেহগুনি, ওলিয়ার রহমানের ২৫ হাজার টাকা মুল্যের ৬ টি মেহগুনি গাছ, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ এর ৮০ হাজার টাকা মুল্যের ৫ টি মেহগুনি, আসাদ মোল্লার ৭০ হাজার টাকা মুল্যের ৯ টি মেহগুনি গাছ, মহিদুল ইসলামের ৩২ হাজার টাকা মুল্যের ৩ টি মেহগুনি, আব্দুল মজিদ মোল্লার ৬০ হাজার টাকা মুল্যের ১৮ টি মেহগুনি ও ৭ টি দেবদারু গাছ সহ বেশ কয়েকজন কৃষকের মুল্যবান গাছ কেটে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এই সকল বিষয় উল্লেখ করে তিনি ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। আরেক কৃষক নাম প্রকাশ না করে জানান, তার ৯ টি গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। তিনি দরিদ্রতার সঙ্গে বসবাস করেন। অনেক কষ্টে গাছগুলো বড় করছিলেন, যেগুলো কেটে বিক্রি করা হয়েছে।
হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাসুম জানান, হরিশংকরপুর গ্রামে হামলা পাল্টা হামলায় দুইজন খুন হওয়ার পর চার গ্রামের প্রায় ৪ শত পুরুষ বাড়ি ছাড়া হয়। প্রতিপক্ষরা গোটা ইউনিয়নে ক্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার তিনিও চান, তবে সাধারণ মানুষের উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, ঘটনায় ২৫ জন আসামী হয়েছে, আর অর্ধশত মানুষের বাড়ি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনও চন্দ্রজানি, শিতারামপুর ও পরানপুর গ্রামের তিন শতাধিক পরিবারের পুরুষ মানুষ বাড়ি ছাড়া রয়েছেন। যারা মাঠে চাষাবাদ করতে পারছেন না। একজনের জমি দখলদাররা চাষ করছেন। তিনি আশা করেন, প্রশাসন ঘটনার সঙ্গে জড়িদের বিচারের ব্যবস্থা আর নিরিহ মানুষগুলোর বাড়ি ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক বসবাসের ব্যবস্থা করবেন। এ বিষয়ে জানার জন্য হরিশংকরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ জানান, গাছ কাটার ঘটনা কোনো তৃতীয়পক্ষ ঘটাচ্ছেন। তার কোনো লোক এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়। একটি মহল দুইপক্ষের গোলযোগের সুযোগ নিয়ে গাছ কাটছে। যেটা তিনিও সমর্থন করেন না।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি (তদন্ত) এমদাদ হোসেন জানান, পুলিশ ইতিমধ্যে বেশ কিছু গাছ জব্দ করেছেন। গত ২৮ অক্টোবর তারা বেশ কিছু গাছ জব্দ করেন। এই ঘটনায় পাওয়া লিখিত অভিযোগ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করার পত্রিয়া চলছে। তিনি আরো জানান, এই গাছ জব্দ করার পূর্বে আরো কয়েকটি গাছ কাটার ঘটনা ঘটেছে শুনেছেন, তবে পরে আর ঘটেনি। আগামীতে কেউ গাছ কাটাকাটি করতে গলে তারা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে জানান।